২০২৪ সালের ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন’ এর সমন্বয়ক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার মাধ্যমে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ও বিতর্কিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের অন্যতম কারিগর হিসেবে স্বীকৃত জনাব নাহিদ ইসলাম ১৯৯৮ সালে ঢাকার অদূরে ফকিরখালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বদরুল ইসলাম পেশায় একজন শিক্ষক এবং মাতা মমতাজ নাহার গৃহিনী।
জনাব নাহিদ ইসলাম ঢাকার দক্ষিণ বনশ্রী মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সালে এসএসসি এবং ২০১৬ সালে সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে এইচএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২২ সালে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করে একই বিভাগে মাস্টার্স অধ্যয়ন করছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই জনাব নাহিদ সামাজিক বৈষম্য নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। মেধা ও ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি রাজনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত হতে উদ্বুদ্ধ হন। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে তাঁর আদর্শ ও লক্ষ্যের ভিন্নতা অনুধাবন করার পরও পরিবর্তনের পক্ষে তাঁর দৃঢ় অবস্থান অতি দ্রুত ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং পরবর্তীতে ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ ছাত্র সংগঠনগুলোর উল্লেখযোগ্য কর্মসূচিতে তাঁকে নেতৃত্বস্থানে এনে দেয়। বিশেষ করে ২০১৮ এর কোটা সংস্কার আন্দোলনে যখন সাদা পোষাকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা তাঁর এক সহপাঠীকে আটক করে, তখন তাঁর সাহসী ভূমিকা তাঁকে সাধারণ প্রতিবাদকারী থেকে আন্দোলনকে জোরদার করা নেতা হিসেবে পরিচিত করে তোলে। এরপর হাসিনা-সমর্থিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও অনুষদের উপর্যুপরি বাধা নেমে আসে তাঁর উপর। সে সময় আন্দোলনটি সফল না হলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে জেগে ওঠা বিক্ষোভ ও প্রতিবাদী মনোভাবের ফলে একের পর এক প্রতিরোধ গড়ে উঠতে থাকে। ২০১৮ এর নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এর উদাহরণ, জনাব নাহিদ এই আন্দোলনেও সাংগঠনিক ভূমিকা পালন করেন।
জনাব নাহিদ ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের (ডাকসু) নির্বাচনে নুরুল-রাশেদ-ফারুক প্যানেল থেকে সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দিতা করেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন, সন্ত্রাস-অত্যাচার-খুন-যৌন নির্যাতনের দায়ে ঐতিহাসিকভাবে অভিযুক্ত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নির্বাচনী কারচুপির মাধ্যমে তাঁকে পরাজিত হতে বাধ্য করে। তরুণ অধিকারকর্মী হিসেবে এই রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও অভিজ্ঞতা জনাব নাহিদকে ‘ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ থেকে বেরিয়ে এসে নেতৃত্ব গুণে পরিপক্ক হয়ে উঠতে সাহায্য করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সাল থেকেই জনাব নাহিদ বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরেক শিক্ষার্থী মাহফুজ আলমকে সাথে নিয়ে গড়ে তোলা ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’ নামে যাত্রা শুরু করা রাজনৈতিক পাঠচক্রকে ২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর তারিখে ডাকসু’র সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আক্তার হোসেনের সমর্থন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অরাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের সূচনা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে ২০২৪ এ এসে, যখন জুন মাসে দেশের সুপ্রিম কোর্ট মুক্তিযোদ্ধার বংশধরদের জন্য ৩০% কোটা পুনর্বহাল করে। সরকারি চাকরিতে ৫৬% কোটা এবং মাত্র ৪৪% মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের এই বৈষম্যমূলক ও অযৌক্তিক কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র করা উক্তি-‘মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা পাবে না তো কি রাজাকারের নাতিরা পাবে?’ মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। জনাব নাহিদের মতো ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে সারা দেশে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ-মানব বন্ধন ও জমায়েত সংগঠিত হতে থাকে।
প্রতিরোধ দমনে বাড়ি থেকে শিক্ষার্থীদের তুলে আনা, সরাসরি গুলি করে হত্যা করার মতো স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার নেওয়া নানা ঘৃণ্য পদক্ষেপ বিক্ষোভের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আবু সাঈদ এবং মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের মতো তরুণরা জীবন দিয়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের পাশাপাশি পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মতো আইন শৃঙ্খলা বাহিনী হাসিনার অনুগত ঘাতক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠেন। এই দুর্যোগময় মুহূর্তে জাতি যখন নেতৃত্ব শূন্যতায় ভুগছিল, তখন জনাব নাহিদের মতো ছাত্র সমন্বয়করা পুলিশের গোয়েন্দা বাহিনী দ্বারা উপর্যুপরি হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েও প্রতিবাদে অনড় থেকে জাতিকে এই বার্তা দেন ‘এখনই হতে হবে নয়তো কখনোই হবে না’। তাঁদের যৌক্তিক আন্দোলনের ফলে হাসিনা সরকারের পতন ঘটে এবং যুগান্তকারী ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার প্রবর্তক নোবেল পুরস্কারজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনুসের নেত্বত্বে অন্তবর্তীকালীন সরকার দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করে। জনগণের পছন্দক্রমে দু’জন ছাত্র সমন্বয়কের একজন হিসেবে জনাব নাহিদ ইসলাম এই সরকারে অন্তর্ভুক্ত হয়ে স্বচ্ছ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে কাজ করছেন।
জনাব নাহিদ ইসলাম সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সম্প্রীতি, নিরাপত্তা, শিক্ষা ও উদ্ভাবন, সাম্য ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার আদর্শে সমুজ্জ্বল একজন স্বপ্নদর্শী নেতা। অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনিও তাৎক্ষণিক লক্ষ্য পূরণে সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে উদ্ধার-ত্রাণ সরবরাহ-পুনর্বাসনে সহায়তা করা এবং ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আহত ব্যক্তিদের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সহায়তা নিশ্চিত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। এছাড়াও মধ্যবর্তী সময়ের মাঝে যেসব লক্ষ্য অর্জনে তিনি ভূমিকা রাখছেন, তা হলো-
১. সকল রাজনৈতিক দলের সাথে নিয়মিত সংলাপে যুক্ত হয়ে এবং বিভিন্ন পেশাজীবি ও নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গীর মূল্যায়ন করে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা;
২. স্বৈরশাসক হাসিনার পতনের পর অস্থিতিশীলতার সম্মুখীন হওয়া সমাজে শৃঙ্খলা ও ন্যায়বিচার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা;
৩. জনগণকে আরও উন্নত সেবা দিতে তথ্য মন্ত্রণালয়কে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা-সম্পর্কিত আইনসমূহকে আপডেট করা;
৪. সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চত করে গণমাধ্যমকে তত্ত্বাবধানের জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গড়ে তোলা;
৫. প্রশাসনিক স্বচ্ছতা আনতে প্রশাসনের সকল ক্ষেত্রে তদন্ত করে কর্মকর্তাদের বিগত সময়ের ভূমিকা যাচাইপূর্বক তালিকা সংরক্ষণ এবং তাদের সম্পদের যথাযথ নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা;
৬. পূর্ববর্তী সরকারের সকল চুক্তির পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণতা যাচাই করে চুক্তির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা বা বাতিল করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া;
৭. শহীদদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার জন্য তহবিল সংগ্রহ করা এবং তাঁদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য শহীদদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একটি ফাউন্ডেশন গড়ে তোলা;
৮. জনগণের প্রকৃত ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচিত হওয়া নিশ্চিত করতে একটি স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়ার নিশ্চয়তা দান।